আদিম মনন

শুকতারা আর সন্ধ্যাতারা


পাওনি উপজাতির পুরাণ

দেবারতি বি

স্বর্গের প্রধান তিরাওয়া,ও তাঁর স্ত্রী আতিরা কে ঘিরে দেবতারা বসে ছিলেন। তিরাওয়া বললেন

"শোন সবাই,আমি তোমাদের সব্বাইকে কিছু ক্ষমতা দেব,আর দেব ব্রহ্মাণ্ডে একটা নির্দিষ্ট জায়গা। আমি নিজের ছাঁচে ঢেলে মানুষ তৈরি করব। তোমাদের জমিজায়গা তাদের দিয়ে দেব, তোমাদের কাজ হবে তাদের দেখাশোনা করা।"

তিরাওয়া সাকুরু বা সূর্যকে পূবদিকে বসালেন, তাঁর কাজ হল আলো আর উত্তাপ দেওয়া। পাহ বা চাঁদ বসলেন পশ্চিমে, তিনি হলেন রাত্রি আর স্নিগ্ধতার প্রভু। তারাদেরও জায়গা নির্দিষ্ট হল। সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাকে বললেন

"তুমি বসবে পশ্চিমে,তোমার নাম হবে সন্ধ্যাতারা। তোমার মধ্যে দিয়েই আমি সবকিছু সৃষ্টি করব।"

শুকতারাকে বললেন

"তুমি বসবে পূবে,তুমি হবে যোদ্ধা। লোকজনকে পশ্চিমে ঠেলে দেবে তুমি,দেখবে কেউ যেন বাদ না পড়ে।"

ধ্রুবতারাকে তারাদের প্রধান করলেন তিনি, দক্ষিন তারাকে বললেন

"তোমাকে সবসময় দেখা যাবে না,বছরের কিছু সময়ই শুধু দেখা যাবে।"

বাকি তারাদের তিনি উত্তর-পূর্ব, উত্তর-পশ্চিম, দক্ষিণ-পূর্ব আর দক্ষিণ-পশ্চিম এই চারভাগে ভাগ করে দিলেন। সন্ধ্যাতারাকে বললেন

"তোমার কাছে আমি মেঘ, বাতাস,বিদ্যুৎ আর বজ্রকে

 পাঠাবো। ওদের পরণে থাকবে মোষের চামড়া,হাতে থাকবে মোষের সিং, কোমরে জড়িয়ে নেবে মোষের লেজ। ওদের তুমি তোমার বাগানের কাছে থাকতে দিও,ওরাই সবকিছু সৃষ্টি করবে।"

দেখতে দেখতে মেঘ জমলো,ঝোড়ো বাতাস বইতে লাগলো, বিদ্যুৎ চমকালো,বাজ পড়লো কড়কড়াৎ করে। ব্রহ্মাণ্ডে খালি জায়গা আর রইলো না। তিরাওয়া সেই মেঘ আর বিদ্যুতের মধ্যে একটা নুড়ি ছুঁড়ে দিলেন,অমনি সেই মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরতে লাগলো। ঝরে পড়ল নিচে,তৈরি হলো মহাসমুদ্র।তিরাওয়া সূর্যকে দিলেন গদা,সেই গদা দিয়ে সূর্য পেটাতে লাগলেন মহাসমুদ্রকে,জল সরে গিয়ে উঠে এলো পৃথিবী। তিরাওয়া এবার আরেকবার ডাকলেন চার দেবতাকে,বললেন

"তোমরা গাও। গাও পাহাড়ের গান,উপত্যকার গান, জঙ্গলের গান, নদীর গান, গাও জীবনের গান।"

আরো একবার মেঘ জমলো,ঝোড়ো বাতাস বইতে লাগলো, বিদ্যুৎ চমকালো,বাজ পড়লো কড়কড়াৎ করে। সেই অতিপ্রাকৃত গানের সুরে সুরে তৈরি হলো পর্বত আর উপত্যকা, বইতে লাগলো ঝর্না আর নদীরা, পৃথিবীতে জন্ম নিলো আদিম অরণ্য।

এইবার তিরাওয়ার আদেশে চাঁদ আর সূর্য মিলিত হলেন,তাঁদের একটা ছেলে হলো। ওদিকে সন্ধ্যাতারা আর শুকতারার মিলনে জন্ম নিলো একটা কন্যা। তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো পৃথিবীতে। অবোধ অনভিজ্ঞ ছেলেমেয়ে দুটি বুঝতে পারলো না তাদের কেন একসঙ্গে পাঠানো হয়েছে। তিরাওয়া আবার ডাকলেন দেবতাদের,বললেন

"আবার গাও তোমরা,গাও প্রেমের গান,যৌনতার গান,মিলনের গান,উৎপাদনের গান।"

তৃতীয়বারের মতো মেঘ জমলো,ঝোড়ো বাতাস বইতে লাগলো, বিদ্যুৎ চমকালো,বাজ পড়লো কড়কড়াৎ করে। ছেলেমেয়েদের পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠলো,  বিদ্যুতের আলোয় চোখ ঝলসে গেলো,বৃষ্টি নামলো অঝোরধারে। সেই ঝড়বাদলের দুর্যোগে কী ইঙ্গিত ছিল কে জানে, ছেলেমেয়েদুটি বুঝতে পারলো তাদের পৃথিবীতে পাঠানোর উদ্দেশ্য। মিলিত হলো তারা,জন্ম নিলো পৃথিবীর প্রথম মানবসন্তান। ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারলো এই শিশুটির সমস্ত দায়িত্ব তাদেরই,একে খাবার দিতে হবে,পোশাক দিতে হবে,এর দেখাশোনা করতে হবে।

এইবার তিরাওয়া দেবতাদের হাত দিয়ে কিছু উপহার পাঠালেন, কিছু নির্দেশ দিলেন। মেয়েটিকে দিলেন বীজ আর বীজ থেকে গাছ বানাবার কৌশল, ঘর আর পূজাবেদী, ঘরের আশেপাশে মেয়েটার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো। আরো দিলেন ফায়ারপ্লেস আর শেখালেন কিকরে আগুন ব্যবহার করতে হয়, পবিত্র ধূমপানের সমস্ত উপকরণ তাকে দিলেন তিরাওয়া, তাকে শেখালেন ভাষার ব্যবহার। ছেলেটাকে দেওয়া হলো পুরুষের পোশাক আর যোদ্ধা হওয়ার গুণাবলি। তাকে গদা দিয়ে বললেন

"মনে রেখো এই গদাই জল থেকে পৃথিবীকে তুলে এনেছিলো।"

তামে শেখানো হলো পশুদের নাম আর ছবি আঁকার কৌশল, তীরধনুক আর পবিত্র হুঁকোকল্কের উপর তার অধিকার স্বীকৃত হলো। দেবতাদের অনুসরণ করে সে পৌছে গেলো সেইখানে,যেখানে বজ্রপাত হচ্ছিলো। সেইখানে সে পেলো তীরধনুক আর শক্ত পাথরের ফলা। তারপর সন্ধ্যাতারা মানুষের স্বপ্নে এসে দর্শন দিলেন। শেখালেন কিভাবে দেবতাদের জন্য নৈবেদ্য সাজাতে হয়,তাতে কী কী লাগে। কী কী জিনিস ঘরে ঝুলিয়ে রাখতে হয় অমঙ্গলকে এড়াবার জন্য। ইতিমধ্যে দেবতারা আরো মানুষ তৈরি করেছেন,তাদের শিখিয়েছেন বেঁচে থাকার কৌশল। এই মানুষরা পৃথিবীর চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল,কিন্তু উপজাতিতে ভাগ হয়নি। তাদের না ছিল নিজস্ব রীতিনীতি, না আচার অনুষ্ঠান। সন্ধ্যাতারা আরো একবার নেমে এলেন মানুষের মাঝখানে। সব্বাইকে একজায়গায় ডেকে চারটে আঁটি দিলেন। একদল লোককে বললেন

"তোমরা থাকবে দক্ষিণ পশ্চিমে, তোমাদের আঁটিতে আছে হলুদ ভুট্টা।"

আরেকদলকে বললেন

"তোমরা যাও উত্তর পশ্চিমে, তোমাদের আঁটিতে আছে সাদা ভুট্টা।"

পরের দলকে বললেন

"তোমাদের জায়গা উত্তর পূর্বে, তোমাদের ভুট্টার রং কালো।"

শেষ দলকে বললেন

"তোমাদের যেতে হবে দক্ষিণ পূর্বে,তোমরা পাবে লাল ভুট্টা।"

এমনি করে পৃথিবী তৈরি হোলো, বিভিন্ন উপজাতির সৃষ্টি হলো, তাদের রকমসকম আচার ব্যবহার সব ঠিক হলো। সেই থেকে শুকতারা আর সন্ধ্যাতারা শুধু আকাশেই থাকে, মানুষের কাছে আর আসেনা।